সমস্ত লেখাগুলি

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা -
পঞ্চানন মন্ডল
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:4 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞান ছিল সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। বিজ্ঞানের মাঝে লুকিয়ে থাকা সাহিত্য সংস্কৃতিকে বারংবার চিনে নিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর জীবন দর্শনে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতা।

মাত্র সাড়ে বারো বছর বয়সে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একটি অস্বাক্ষরিত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন- ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। অনেকে বলেন যে, গ্রহগণ জীবের আবাসভূমিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনা। পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ অন্তত দু’ জায়গায় সেই কিশোর বয়সে লেখা রচনাটির উল্লেখ করেছিলেন। এই লেখার অনেক অনেক বছর পর শেষ বয়সে এসে কবিগুরু একশ’ পনেরো পৃষ্ঠার আরেকটি বিজ্ঞানভিত্তিক বই প্রকাশ করেন, ‘বিশ্বপরিচয়’। শুধু তা-ই নয়, তিনি বইখানি উৎসর্গ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার কৃতি শিক্ষক ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। 

রবীন্দ্রনাথ তার উৎসর্গপত্রে লিখলেন—

‘বয়স তখন হয়তো বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিগৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছিলুম। স্বাদ পেয়েছিলুম বলে লিখেছিলুম। জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। একজন মহাকবির সাথে এক মহাবিজ্ঞানীর দেখা হতেই হবে। যদিও বয়সের একটা বড় ব্যবধান ছিল। সেটা ১৯৩০ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঊনসত্তর বছর পেরিয়ে সত্তরে পা দিয়েছেন। আইনস্টাইনের বয়স তখন বাহান্ন। রবীন্দ্রনাথের থেকে আইনস্টাইন ১৮ বছরের ছোট ছিলেন। ১৯৩০ সালেই রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হিবার্ট বক্তৃতা দিতে গিয়ে ‘সভ্যতার সংকট’ পাঠ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে কবি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ও পারস্যে তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে যান। বার্লিনে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হবার আগে রবীন্দ্রনাথ কি আইনস্টাইনকে জানতেন? জানতেন বৈকি।


১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। এই বর্বরতার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করলেন।

১৩ এপ্রিল অমৃতসরের চারদিকে পাকা প্রাচীরের ভেতর চলছিল একটি ব্রিটিশবিরোধী সভা। বের হবার পথ ছিল একটাই। হঠাৎ ব্রিটিশ সামরিক অফিসার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য বেপয়োরা গুলি বর্ষণ করে। ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালানোর পর গুলি ফুরিয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড এমনি জঘন্য ছিল কতজন মারা গিয়েছিল তার চেয়ে দেখার ছিল কতজন বেঁচে ছিল। যাইহোক, গভর্নর জেনারেলের একজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভ্য স্যার শঙ্করণ নায়ার বার্ষিক চৌষট্টি হাজার টাকার বেতনের চাকরিতে ইস্তফা দেন; কিন্তু ‘নাইট’ খেতাব বর্জন করেননি। অথচ পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনে চাকরি ত্যাগ করার জন্য স্যার শঙ্করণ নায়ারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হলেও ‘নাইট’ ত্যাগ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। ১৯১৯ সালেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁ যখন মানুষের স্বাধীনতা বিষয়ক দলিল তৈরি করেছেন, সেই দলিলে স্বাক্ষরকারী মানুষদের মধ্যে দু’জন মানুষের নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন।














১৯০২, সালের ১০ মে বিশ্বনন্দিত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু রয়্যাল ইনস্টিটিউটে ‘যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক তাড়নায় জড়পদার্থের সাড়া’ বিষয়ক গবেষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। তার দশদিন আগে ১ মে তারিখে রবীন্দ্রনাথকে লন্ডন থেকে জগদীশচন্দ্র লিখলেন -

‘তুমি তো এতদিন নির্জ্জনে সাধনা করিয়াছ, বলিতে পার কী, কী করিলে সুখদুঃখের অতীত হইতে পারা যায়? একদিন ভারতে সুদিন আসবেই, কিন্তু একথা সর্বদা মনে থাকে না। ইহা যে সত্য একথা আমার মনে মুদ্রিত করিয়া দাও। একটা আশা না থাকিলে আমার শক্তি চলিয়া যায়।’

১০ মে বিলেতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। দু’দিন আগে ৮ মে তাঁর মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় নিচের চিঠিতে -

‘আমি যে কি কষ্টের ভেতর দিয়া যাইতেছি তুমি জানিবে না। তোমরা নিরাশ হইবে একথা মনে করিয়া আমি এখানে কিরূপ বাধা পাইতেছি তা জানাই নাই।... এই যে গত বৎসর মে মাসে যে আবিষ্কার সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম……। আমার সেই আবিষ্কার চুরি করিয়া ... নভেম্বর মাসে এক কাগজে বাহির করিয়াছে!’

আসলে লিনিয়ান সোসাইটির কাউন্সিল সভায় যখন ঠিক হয় যে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্রটি ছাপা হবে, তখন বিজ্ঞানী এর বন্ধু বিজ্ঞানীরা কাউন্সিল সভায় জানান যে, এমন কাজ নাকি একজন গত নভেম্বরে প্রকাশ করেছেন। এ কাজের আর কোন গুরুত্ব নেই। জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্রটি তাই মুদ্রণের জন্য বিবেচিত হতে পারে না।

একসময় কথাটা জগদীশচন্দ্রের কানে যায়। জগদীশচন্দ্র সব জানিয়ে লিনিয়ান সোসাইটির সভাপতিকে চিঠি লেখেন। সভাপতি তাঁকে একসময় জানান, ভুল বুঝতে পেরেছেন ওঁরা।

তখনই জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন -

‘.... ভাঙিয়া গেলে আর কি থাকে। এতদিন এদেশের বিজ্ঞানসভায় অনেক বিশ্বাস করিয়াছি_ তাহা দূর করিয়া লাভ কি? অধিক দিন থাকিতে পারিলে আমি একাই বূহ্য ভেদ করিতাম_ কিন্তু আমার মন ভাঙিয়া গিয়াছে।’

১ মে জগদীশচন্দ্র লিখছেন, ‘একটা আশা না থাকিলে আমার শক্তি চলিয়া যায়। ৮ মে লিখছেন, ‘... আমার মন ভাঙিয়া গিয়াছে।’

বিজ্ঞানীর এই মানসিক বিষণ্নতা অনুভব করে রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে বারবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর প্রতিভা যে ব্যতিক্রমী, একথা কবি তাঁকে অনেকবার নানাভাবে বুঝিয়েছেন।

জগদীশচন্দ্র প্রতুত্তরে লিখছেন, ‘তুমি কি মনে কর যে আমি এক কেষ্টবিষ্টু হইয়াছি। গলায় পাথর বান্ধিয়া জলে ফেলিলে ভাসিয়া উঠিব?’ (৩০ মে, ১৯০২)।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে জগদীশচন্দ্রকে বারবার উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। আর স্বদেশে তাঁর কাজের বিষয়ে, তাঁর সাহসী লড়াইয়ের বিষয়ে নিবন্ধ রচনা করা উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন। সেই বিবেচনাবোধ থেকেই ‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা’ রচিত হয়েছে।


আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুখোমুখি পরিচয় হয় ১৯২৬ সালে। কবি তখন দ্বিতীয়বার জার্মানি গিয়েছেন। হিটলারের উত্থান তখনও স্পষ্ট হয়নি। কী আলোচনা হয়েছে দু’জনের সে সময়, কোন লেখাপত্র বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের মনে যে শ্রদ্ধার রেখা টেনেছিলেন, ১৯২৬ সালে লেখা আইনস্টাইনের একটি চিঠি থেকে সে প্রমাণ পাওয়া যায়। চিঠির তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬। ছোট্ট চিঠি, দু’একটি লাইন উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

মাননীয় আচার্য,

... আপনাকে স্বচক্ষে দেখে আসতে না পারার জন্য দুঃখিত। শুনেছি আপনার উপর প্রচুর ধকল গেছে। তাই ভিড় বাড়িয়ে আপনার বিশ্রাম এবং শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। জার্মানিতে যদি এমন কিছু থাকে যা আপনি চান এবং যা আমি করতে পারি, দয়া করে, যখন খুশি আমায় আদেশ করবেন।”

আইনস্টাইন ১৯২৬ সালে অপরিচিত কেউ নন। নোবেল জয় করেছেন পাঁচবছর আগে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর এমন নিবেদন আমাদের অন্য একটি ঘটনার কথাও মনে করিয়ে দেয়। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের যে বিখ্যাত গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল তাঁর জন্য আইনস্টাইনের ভূমিকা কী ছিল আমরা জানি। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অপরিচিত যুবক। তিনি আইনস্টাইনকে গভীর বিনয়ী চিঠি লিখতেই পারেন। আইনস্টাইনের লেখা রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চিঠি আমাদের আইনস্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। রবীন্দ্র প্রতিভার বিশ্বজনীনতাকে বুঝতে সহায়তা করে।

আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের দিনটি ছিল ১৪ জুলাই, ১৯৩০। বিশ্বের বহু সংবাদপত্রে তার সবিস্তার বিবরণী বেরিয়েছিল। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’-এ সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই বইয়ে আইনস্টাইন নিজে রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি লেখাও দিয়েছিলেন। ১৪ জুলাই বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা বিষয় নিয়ে দু’জনের কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি আলোচনায় ঈশ্বর প্রসঙ্গও এসেছে। আইনস্টাইন তখন বার্লিন থেকে খানিকটা দূরে কাপুথ নামে একটা ছোট্ট শহরে থাকতেন। আইনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ যান। দু’জনের বেশ খানিকটা সময় ধরেই কথা হয়। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর বইতে লিখেছেন-’কোথাও কি তাঁদের মিল ছিল না? অবশ্যই ছিল। দু’জনেই আদর্শবাদী ছিলেন। দু’জনেরই প্রবল বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার অধিকার। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সেই বিপন্ন সময়ে দু’জনেই বিশ্বশান্তির সপক্ষে কাজ করেছিলেন এবং সে-বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির প্রবল প্রতাপ সম্বন্ধে দুজনেই প্রতিকূল ছিলেন। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক দিয়ে তাঁদের মনে মিল ছিল।’

১৪ জুলাইয়ের পর ১৯৩০ সালে আরও তিনবার দু’জনের দেখা হয়। ১৯ আগস্ট বার্লিনে দেখা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষে আবার বার্লিনে দেখা হয়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিউইয়র্কে দেখা হয়। দু’জন বড় মাপের মানুষ এক বছরে চারবার পরস্পর মিলিত হচ্ছেন, হৃদমাঝারে কোন আত্মীয়তা না থাকলে তা কখনও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে না।

ওই সময় ১৯ আগস্ট কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। একটু বিষয় বদলে যায়। আইনস্টাইন প্রথম ক’বছর কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। সে কথার ইঙ্গিত আমরা আগে রেখেছি। কথায় কথায় সঙ্গীত প্রসঙ্গ চলে এল। পুবের সঙ্গীত ও পশ্চিমের সঙ্গীত নিয়ে কথা হলো। রবীন্দ্রনাথ বললেন, পাশ্চাত্যে স্বরলিপি কঠোরভাবে মানতে হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি থাকলেও শিল্পীদের স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে সঙ্গীতকে ‘শিল্প’ করে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় সঙ্গীতে বাণীর প্রাধান্য কেমন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, উত্তর ভারতে কম, বাংলায় বেশি। কতটা বাদ্যযন্ত্র থাকে, জানতে চাইলেন আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের উত্তর ছিল, পশ্চিমি গানের ‘হারমনি’ তৈরির জন্য নয়। তাল ও মাত্রা ঠিক রাখার জন্য বাদ্যানুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অন্যতম মেধাবী ছাত্র ছিলেন প্রমথনাথ সেনগুপ্ত। বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা ‘বিশ্বপরিচয়’ এর সাথে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ একবার প্রমথনাথকে বলেছিলেন - ‘শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেও না, এখানে তোমার প্রয়োজন আছে... যেদিন দেখবে এখানে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, শিক্ষার চেয়ে শাসনযন্ত্রটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে, সেদিন তুমি চলে যেও।’

সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের গ্রন্থ লিখতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, ‘এই পুণ্যকাজে আমার আশীবার্দ রইল।’ (আনন্দরূপম পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪)

এখানে আমাদের আলোচনার বিশেষ সুযোগ নেই। তবু মনে রাখতে হয়, শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানকে তাঁর ভাবনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয় করে তুলেছিলেন। আগেই বলেছি, ছিয়াত্তর বছর বয়সে ‘বিশ্বপরিচয়’-এর পাণ্ডলিপি প্রস্তুত করেছেন তিনি। জীবন সায়াহ্নে তাঁর ‘তিন সঙ্গী’ গল্পগ্রন্থ, যা ‘রবিবার’, ‘শেষ কথা’ ও ‘ল্যাবরেটরি’ নামের তিন বিখ্যাত ছোট গল্পের সংকলন, সেখানেও তিনি বিজ্ঞান চিন্তাকেই গল্প তিনটির মূল ভাবনা হিসাবে পেশ করেছেন। তিন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রেরা সকলে জীবিকাসূত্রে ‘বিজ্ঞান’ নির্বাচন করেছিলেন। গল্পের শেষে দেখা যায়, তারা সকলেই অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের জালে বাঁধা পড়ে আছেন। ‘সমগ্র’ বিজ্ঞানকে অনুভব করার কথা বলতেন তিনি। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে তথ্যের প্রাচুর্য থাকলেও এই ভাবনাকেই তিনি চূড়ান্ত রূপ দিতে চেয়েছেন। আমরা বলব, সার্থক হয়েছে তাঁর এই চাওয়া।

তাঁর বিজ্ঞানশিক্ষা বা বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস যাই হোক, এটা সত্যি এক অভাবিত বিজ্ঞানবোধ তাঁর মনন ও কল্পনা উভয়কেই আচ্ছন্ন করেছিল। তার একটি উপাদান হলো এই বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা। খুব অল্পবয়সেই এই অস্তিত্বের বিশাল পরিসর সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বুঝে উদ্ভাসিত হয়ে ‘আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ’ সম্বন্ধে তার একটি বোধ তৈরি হয়েছিল। এই বোধ তার কবিত্বকে সমৃদ্ধ করেছে, কারণ এর উৎস বিজ্ঞান হলেও এর মধ্যে জন্ম দিয়েছে এমন এক বিস্ময়, তাই বলেছিলেন -

‘তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ..


(বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংকলন করে লেখা)

(আমার কণ্ঠস্বর বা বাচনভঙ্গি কোনোটাই ভালো নয়। তবুও এই প্রথম লেখা পাঠ করলাম। ভুলত্রুটি নিজগুণে ক্ষমা করবেন।)

https://youtu.be/5UlYa2N2As4


মৌমাছি সমাজে শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি -
পঞ্চানন মন্ডল
May 19, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:4 | likes:0 | share: 0 | comments:0

‘মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।

ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই…’

মৌমাছির জীবনে আছে অসম্ভব ব্যস্ততা। আমরা মানুষরাও কম ব্যস্ত নই।  কিন্তু অনেক প্রকৃতি প্রেমিক, গবেষক, বিজ্ঞানী আছেন যারা দিনরাত এক করে মৌমাছির জীবন রহস্য সম্বন্ধে অনেক কিছু আমাদের কাছে উন্মোচিত করেছেন। তবে আমাদের অনেকের মৌমাছির কাছে যাওয়ারও সাহস হয় না তাদের হুলের কারণে। তারপরও রাস্তা ঘাটে মৌচাক দেখলে আমাদের অনেকের কেন যে ঢিল ছুঁড়তে ইচ্ছে করে, কে জানে! এমনিতে মৌমাছি কখনও বিনা কারণে কাউকে আক্রমণ করে না, এরা খুবই শান্তি-প্রিয় প্রতঙ্গ। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে কোন ছাড় নেই, তখন এরা এদের একমাত্র অস্ত্র হুল প্রয়োগ করতে এরা দেরি  করে না।


মৌমাছি খুবই পরিশ্রমী, দলবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক সামাজিক প্রাণী। এদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে! এদের সমাজে সবার কাজ নির্দিষ্ট, চেইন অফ কমান্ড এর বিন্দুমাত্র নড়চড় হয় না কখনও; হয় না কোন বিদ্রোহ। এখানে দুর্বলের কোন স্থান নেই, অত্যাচারীও নেই এখানে। নিজ দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এরা পিছপা হয় না কখনই। কঠোর পরিশ্রমী, আত্ম-ত্যাগ ও নিষ্ঠাই এদের ৩০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছে।


মৌমাছির সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিংবা অসাধারণ গুণের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে মৌ নৃত্যর  (bee dance)  কথা। তবে এ নাচ তো শুধুই নাচ নয়, এ তাদের ভাষা। এই নাচের মাধ্যমেই মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে, খবরাখবর আদান প্রদান করে থাকে, তার সঙ্গে করে খাবারের সন্ধান। মৌমাছির এই অদ্ভুত কম্যুনিকেশনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ। তাঁর জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে পান নোবেল পুরস্কার। 


তিনিই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে দেখান যে, মৌমাছি নাচ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন  করে, খাবারের সন্ধান পায়।

খাদ্য সন্ধানকারী কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছিরা প্রধানত দুই ধরনের মৌ নৃত্য করে থাকে, বৃত্তাকার বা চক্রাকার নৃত্য ও ওয়াগল নৃত্য।


বৃত্তাকার বা চক্রাকার মৌ নৃত্য-

খাদ্যের উৎসের দূরত্বের উপর নির্ভর করে খাদ্য সন্ধানে শ্রমিক মৌমাছিরা এই নৃত্য প্রদর্শন করে। খাদ্যের উৎস কাছাকাছি মানে ১০০ মিটারের মধ্যে হলে এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শিত হয়। খাদ্য সন্ধানী মৌমাছিদের পিছনে সংগ্রাহক মৌমাছিরাও তখন ধাবিত হয় ও তারাও একই রকমভাবে নাচতে থাকে। চক্রাকার নৃত্য নিকটবর্তী স্থানে খাদ্যের উৎস সম্পর্কে অন্যকে জানাতে এবং পক্ষান্তরে সেই উৎস থেকে মৌমাছিকে খাদ্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।


ওয়াগল ডান্স বা ওয়াগল নৃত্য-

ইংরেজি ওয়াগল শব্দের অর্থ আন্দোলন বা কম্পন। খাদ্যের উৎস বেশি দূরে হলে মানে ১০০ মিটারের বেশি হলে কর্মী মৌমাছিরা এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শন করে। এই নৃত্য ইংরেজি 8 সংখ্যার মত আকৃতির মতো হয়। এরা একবার ডান দিকে ও একবার বাঁদিকে ফাঁস বা লুপ তৈরি করে এবং নাচের সময় লুপ এর মধ্যে সরলরৈখিক অংশে সন্ধানী মৌমাছি ওপর-নিচে নিজেকে আন্দোলিত করে আর খাদ্যের উৎসের দিকে ধাবমান হয়।


ওয়াগল বৃত্তের সমীকরণ এর মাত্রা থেকে খাদ্যের অবস্থানের দূরত্ব সম্পর্কে মৌমাছি জানতে পারে। সূর্যের সাপেক্ষে নৃত্যের  কৌণিক অভিমুখ থেকে খাদ্যের উৎস এর দিক নির্ধারণ করে। ঊর্ধ্বমুখী নৃত্য  থেকে বোঝা যায় যে খাবারের উৎস এর অবস্থান সূর্যের দিকে এবং নিম্নমুখী নৃত্য  থেকে বোঝা যায় যে খাবারের অবস্থান সূর্যের বিপরীত দিকে।


অর্থাৎ মৌমাছির রয়েছে অসাধারন দিক জ্ঞান এবং নিখুঁত দূরত্ব  মাপার ক্ষমতা। কোন মৌমাছি যখন খাবারের অথবা মধুর নির্যাসের(মানে মকরন্দ বা নেকটার) কোন উৎস (ফুল) খুঁজে পায় তখন সে মৌচাকে এসে নৃত্যের  মাধ্যমে সকলকে খবর দেয়। সে শরীর দোলাতে থাকে এবং নাচতে থাকে এমন এক পথ ধরে যার মাধ্যমে সে উৎসের দিক বোঝাতে পারে। এরা এই দিক ঠিক করে সূর্যের সাপেক্ষে যাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক বোঝা যায়। 


মৌমাছির নৃত্যের  সময়ব্যাপ্তি এবং কম্পনের (দোলা) সংখ্যা দিয়ে সে বোঝায় ঠিক কত দূরে আছে ফুল এবং ফুলে কি পরিমাণ মধুর নির্যাস রয়েছে, যেমন ১ সেকেন্ডের দোলন বোঝায় উৎস রয়েছে ১ কিমি দূরে।

এসব তথ্য এবং সূর্যের গতিবিধি’র নিখুঁত হিসেব করে মৌমাছিরা ফুল/খাবার এর কাছে পৌঁছানোর নুন্যতম ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দূরত্ব  বের করে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছির এই সকল হিসেবের দক্ষতা খুব বেশি এবং সময়ও লাগে কম। উল্লেখ্য মৌমাছি সূর্যের আলোর হিসেব করতে পারে এবং পৃথিবী গোল হওয়ায় যে বক্রতার একটা ব্যাপার আসবে তাও তাদের নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করে।


মৌমাছি সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে চলাফেরা করে।

 তাই যখন আকাশ মেঘলা থাকে, সূর্য মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়,  তখন এরা এদের বিশেষ আলোক-গ্রাহক (ফটো-রিসেপ্টর) ব্যবহার করে পোলারাইজড আলো কাজে লাগিয়ে সূর্যের সঠিক অবস্থান বের করে ফেলে। এজন্য অতিবেগুনী (আল্ট্রা-ভায়োলেট) আলোরও সাহায্য পড়ে, সে ক্ষমতাও আছে এদের। এছাড়াও সূর্য আবার  সবসময়ে সব ঋতুতে আকাশের এক জায়গায় থাকে না! তাতেও সমস্যা নেই!  কারণ, মৌমাছির মাথায় আছে প্রাকৃতিক ঘড়ি! যার মাধ্যমে এরা সূর্যের গতিবিধি সবই হিসেব করতে পারে।


মৌমাছিরা গাছের ডালে বা কার্নিশে বড়-বড় চাক তৈরি করে। প্রতি চাকে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মৌমাছি থাকতে পারে। এক-একটি চাকে এত-এত মৌমাছি থাকলেও  তাদের নিজেদের মধ্যে ঝুট ঝামেলা করতে বা মারামারি করতে দেখা যায় না। অবশ্য সময়ে অসময়ে এক চাকের মৌমাছি অন্য চাকের মৌমাছিগুলিকে আক্রমণ করে লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। মৌমাছিরা ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করে সমাজের স্বার্থে কাজ করে যায়। এমনকি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। মৌমাছিরা অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে  তাদের দিনযাপন করে।

এরা শীতকালে তেমন কাজ করে না। সারা শীতকালটা এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর করে কাটায়। কিন্তু বসন্তের আগমনে এরা পুরোনো ছন্দে ফেরে। মধু আহরণ, চাক  নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসার আবর্জনা পরিষ্কার বলুন আর শত্রুদের সামলানো বলুন যেভাবে অত্যন্ত শৃঙ্খলা ও তৎপরতার সাথে কাজ করে, তা দেখলে আপনি বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা, কেউ কারোর কাজে বাধা সৃষ্টি করে না। সবাই যেন নিজ নিজ কাজের প্রতি দায়বদ্ধ। যেন কিছুটা রোবটের মতো কাজ করে যাচ্ছে। দেহ মনে কোনও ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, অন্যের উপর দোষারোপ নেই।


একটি মৌচাকের  মৌমাছিকে আমরা দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি – অত্যন্ত কর্মপটু শ্রমিক মৌমাছি আর ওপর দল সম্পূর্ণ কর্মবিমুখ রানি ও পুরুষ মৌমাছি। আগেই বলেছি শ্রমিকরা চাক নির্মাণ, মকরন্দ সংগ্রহ, মধু তৈরি, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসা রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শত্রুদমন সবই করে। পুরুষরা মৌমাছি প্রধানত আহার-বিহারেই মত্ত থাকে। আর রানী মৌমাছির বংশবৃদ্ধি ছাড়া কোনও কাজ নেই। পুরুষেরা প্রায়ই দিনের শেষভাগে উচ্চ শব্দ করে বাসা থেকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ প্রমোদ ভ্রমণ করে বাসায় ফিরে  আসে। প্রত্যেক চাকে সাধারণত একটি মাত্র পরিণত বয়স্ক রানি মৌমাছি দেখা যায়।  মৌমাছিদের সামাজিক কার্যকলাপ দেখলে মনে হবে – একটিমাত্র রানীকে ঘিরেই তাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে রানি বলে সে যে সবাইকে শাসনে রেখেছে এমনটি ভাববেন না। এদের মধ্যে রাজতন্ত্র বা রাণীতন্ত্র বলে কোনও কিছুই নেই। রানির একমাত্র কাজ প্রজনন। একটি মাত্র রানিই চাকের প্রায় অধিকাংশ মৌমাছির মাতা। ডিম পারা আর আর পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে বৈবাহিক উড্ডয়নরত অবস্থায়  যৌন মিলন ছাড়া তার তেমন  কোনও কাজ নেই। তাই শ্রমিক মৌমাছি আছে বলে মৌচাক আছে, মৌমাছির সমাজ টিকে আছে। মৌমাছি সমাজে রানি বা কোনও রাজা নয় শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি। আর তাদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে,কাজ করে আর নেচে গেয়ে।

অজানা জ্বর না ডেঙ্গু? চেনার ও পরিত্রাণের উপায় কি? -
পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 25, 2024 | সচেতনতা | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ডাক্তারি পরিভাষায় 'Pyrexia (fever) of Unknown Origin' অর্থাৎ 'অজানা জ্বর'-এর সংজ্ঞা হিসাবে Petersdorf and Beeson বলেছেন -

"A temperature greater than 38.3°C (101°F) on several occasions, accompanied by more than three weeks of illness, failure to reach a diagnosis after one week of inpatient investigation."

তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে জ্বর, সমস্ত পরীক্ষা করেও যার কারণ জানা যায় না, তাকেই বলে 'অজানা জ্বর'।

ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞাও ভারত সরকারের ইন্টিগ্রেডেড ডিজিজ সারভেইল্যান্স প্রোগ্রামে বলা আছে:-

"২ থেকে ৭ দিনের জ্বর, তার সঙ্গে নীচের যে কোনো দু'টি লক্ষণ-

মাথাব্যথা

পিছনে ব্যথা

পেশীতে ব্যথা

গাঁটে গাঁটে ব্যথা

রাশ

রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা কম"

এছাড়াও বলা আছে, যে এলাকায় যে সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানে সেইসময় যে কোনো জ্বরের কেস যদি রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া নেগেটিভ হয়, তাহলে তাকে ডেঙ্গু বলেই ধরতে হবে (epidemiologically linked Dengue)। সুতরাং ডেঙ্গুর সঙ্গে অজানা জ্বর গুলিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই।


ডেঙ্গু কনফার্মেশনের জন্য মূলতঃ যে পরীক্ষাগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এবং ভারত তথা পঃ বঙ্গ সরকার দ্বারা স্বীকৃত, সেগুলি হ'ল -

জ্বর শুরুর পাঁচদিনের মধ্যে ELISA পদ্ধতিতে রক্তে NS1 অ্যান্টিজেনের অস্তিত্ব দেখা।

জ্বর শুরুর পাঁচদিন পরে ডেঙ্গু-স্পেসিফিক ইমিউনোগ্লোবিন M বা IgM -এর অস্তিত্ব দেখা।

পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR) পরীক্ষা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলছে -

"There is no specific treatment for dengue fever. Severe dengue is a potentially lethal complication but early clinical diagnosis and careful clinical management by experienced physicians and nurses often save lives."

অর্থাৎ, ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসকের পূর্ণ অধিকার আছে রোগীর মৃত্যু হ'লে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস লেখার। বিশেষতঃ যেখানে ল্যাবরেটরি অপ্রতুল, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা করতে হয়।

ডেঙ্গুর এখন মোট পাঁচটি সেরোটাইপ। পঞ্চমটি মালয়েশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ ক'বছর হ'ল, ভারতে এখনো অব্দি রিপোর্টেড নয় এই স্ট্রেইন। তবে তার বাহক এডিস নিভিয়াস কিন্তু এদেশে রয়েছে।


ডেঙ্গুর ইতিহাস

ডেঙ্গুর মশা, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম এডিস ইজিপ্টি, সাধারণত দিনে কামড়ায়। সুতরাং, শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলাতেও আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে মশা না কামড়াতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী মশারা সাধারণত রাতে কামড়ায়। এই মশারা যখন ওড়ে, তখন পোঁ পোঁ করে আওয়াজ হয়। ডেঙ্গুর মশাদের ক্ষেত্রে এরকম আওয়াজ হয় না ঠিকই, কিন্তু এদের চেনার উপায় হচ্ছে গায়ে ডোরাকাটা দাগ।


ডেঙ্গু শব্দটি সোয়াহিলি ভাষা ডিঙ্গা থেকে এসেছে। যার অর্থ সাবধানতা। ডেঙ্গু আক্রান্তরা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য খুব ধীরে হাঁটাচলা করেন, মনে হয় যেন সাবধানে চলছেন। সেই থেকে এই ডিঙ্গার ব্যবহার। এই অসুখের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক চিনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াতে ২৬৫-৪২০ খ্রীষ্টাব্দে ডেঙ্গুর মতো এক অসুখের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম সুনিশ্চিত ডেঙ্গুর কথা পাওয়া যায় ১৭৮৯ সালে, যার ব্যাখ্যা করেন বেঞ্জামিন রাস। তিনি হাড়ভাঙ্গা রোগ বলে অসুখটির বিবরণ দেন। সুতরাং, ডেঙ্গু বহুদিন ধরেই মানুষকে আক্রান্ত করছে।


ডেঙ্গুর প্রকারভেদ -

ডেঙ্গুর কারণ হল ডেঙ্গু ভাইরাস। যার বাহক হল এডিস ইজিপ্টি মশকী। যার কামড়ে মানুষের রক্তে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গু হয়। এটি একপ্রকারের ফ্লাভি ভাইরাস।

ডেঙ্গু চার প্রকারের হয়।

ডেঙ্গু-১, ডেঙ্গু-২,ডেঙ্গু৩, ডেঙ্গু-৪।

ডেঙ্গু-২ অন্য তিন ভাইয়ের থেকে একটু বেশিই আক্রমণাত্মক। রক্তে এদের সংখ্যা বা যাকে বলে ভাইরাল লোড, খুব বেশি থাকে। তার ফলে,এই ডেঙ্গুর দরুণ অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বা জটিলতা বেশি হয়। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে ডেঙ্গু-২ এর এপিডেমিক হয়েছিল।


ডেঙ্গুর লক্ষ্মণ -

আগেই উল্লেখ করেছি ডেঙ্গু হলে জ্বর, গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, পেট ব্যাথা ও চোখের ভেতরে ব্যাথা হতে পারে। গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যেতে পারে। যে সমস্ত মহিলাদের জ্বরের সময় মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ডের সময় হয়ে আসে, তাদের রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। ডেঙ্গুতে শ্বেতরক্তকণিকা ও অনুচক্রিকা (platelet) কমতে শুরু করে। অনুচক্রিকা কমতে কমতে যদি বিপদ সীমার নিচে চলে যায়, বা অনুচক্রিকা কমার হার যদি অনেকটা হয়, তাহলে চিকিৎসকেরা অনুচক্রিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাকে বলে platelet transfusion। বাজারে পেঁপে পাতার রসের খুব প্রচলন হয়েছে অনুচক্রিকা বাড়ানোর জন্য। কিছু ওষুধের কোম্পানি ট্যাবলেটের আকারে বাজারে বের করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, এর প্রয়োগে অনুচক্রিকা বাড়ে, তা নিশ্চিতভাবে এখনো প্রমাণিত নয়। 


এর জন্য আরও ক্লিনিক্যাল স্টাডির প্রয়োজন আছে।

এই অনুচক্রিকা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন নাক, দাঁতের মাড়ি, পাকস্থলী ইত্যাদি। শরীরে চামড়ার তলায় ছোপ ছোপ লালচে দাগ দেখা যেতে পারে। যার অর্থ চামড়ার তলায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বলে। এই রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের সঞ্চালন সঠিক পরিমাণে হয় না। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে ‘ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ বলে। এছাড়াও ডেঙ্গুর জন্য পেটে বা ফুসফুসে জল জমতে পারে। যাকে ডেঙ্গু ক্যাপিলারি লিক সিনড্রোম বলা হয়। এর থেকেও শক সিনড্রোম হতে পারে। এছাড়াও, ডেঙ্গির জন্য মানুষের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম বা অনাক্রম্যতন্ত্র বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। এই ভয়ঙ্কর জটিলতার নাম ম্যাক্রোফাজ অ্যাক্টিভেশন সিনড্রোম।


কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?

ডেঙ্গুর NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পজিটিভ এলে।সেইসাথে যদি আপনার পেট ব্যথা হয়, বা খুব বমি হয়, পেটে বা ফুসফুসে জল জমে, অথবা রক্তক্ষরণ হয়।আর অণুচক্রিকার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে।


ডেঙ্গুর পরীক্ষা

ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পড়তে পারে। সুনিশ্চিত পরীক্ষার জন্য ডেঙ্গু সেরোলজি পজিটিভ আসে জ্বর শুরুর ৬ দিনের পর থেকে।



কী করে বুঝবেন কারো ডেঙ্গু হয়েছে?

কমপক্ষে ৫ দিন ধুম জর থাকবে৷ 

ওষুধ খেলেও কিছু ক্ষণের জন্য জ্বর কমলেও তা বারে বারে ফিরে আসবে৷

মাথা ও চোখের পিছনদিক-সহ গোটা শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতা অনুভব করবেন৷

চামড়ায় র‍্যাশ হতে পারে৷ 

বমি, ডায়েরি, সর্দি কাশি হলে বেশিদিন ফেলে রাখবেন না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন৷

হেমারেজিক ডেঙ্গুতে অনেক সময় মাড়ি ও নাক থেকে রক্তপাত হয় ৷ 

প্রস্রাব ও মলের সঙ্গেও রক্তপাতের সম্ভাবনা৷

হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে৷


ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে, কি কি করবেন?

যেকোনো ভাবেই আপনার এলাকাই মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করুন।

আবর্জনা পরিষ্কার করুন ৷পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।

জল যাতে না জমে সেদিকে বিশষ নজর রাখুন৷

মশা মারা তেল বা স্প্রে ব্যবহার করুন ৷

খোলা ড্রেন পরিষ্কারের ব্যবস্থা করুন ৷

জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ৷

মশারি ব্যবহার করুন।

অযথা আতঙ্কিত হবেন না।

জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা করুন ৷


ডেঙ্গু সংক্রমণে লিভারের বিভিন্ন এনজাইম বেড়ে যায়। এর ফলে লিভারের বিশ্রাম দরকার। কোনও ভাজা-মশলাদার খাবার, তৈলাক্ত খাবার, বাইরের খাবার অন্তত তিন মাস বর্জন করলে লিভার আবার স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে শুরু করে। খাওয়াদাওয়ায় এই নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাড়ি ফিরে ডেঙ্গু রোগী হজমজনিত কোনও সমস্যায় কষ্ট পাবেন না।

যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের ক্ষেত্রে গায়ে লালচে দাগ বেরোয় জ্বর কমার পরেই। আর তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে প্লেটলেট। এটাই রীতি। তাই জ্বর কমে গেল হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া কখনওই উচিত নয়।


এছাড়াও, যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জ্বরের সময়েই প্লেটলেট কমে যায়। যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের কিন্তু গায়ে লালচে দাগ বেরোয় এবং প্লেটলেট কমে জ্বরটা সেরে যাওয়ার পরেই। এটা সবার জানা উচিত।

ডেঙ্গুর সময়ে মেয়েদের কোমরের (পেলভিক অঞ্চলের) বিভিন্ন টিস্যু অতিরিক্ত ফুলে যায়। তাই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হলে তলপেটে ব্যথা হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। এর জন্য কোনও প্রতিষেধক নিতে হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আবার না-ও হতে পারে। কার হবে, আর কার হবে না, সেটা আগে থেকে বলা সম্ভবও নয়।

বিভ্রান্তি দূর করে কিছু ক্ষেত্রেও রোগ সেরে যাওয়ার পরে অন্তত মাস তিনেক সতর্ক ভাবে থাকতে হবে।


সচেতন থাকুন। সুস্থ থাকুন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখুন।


(আমি ডাক্তার নই। বিভিন্ন বইপত্র, পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ভুলত্রুটি থাকলে বিশেষজ্ঞগণ সংশোধন করে দেবেন।)

বার্নাম এফেক্ট -
পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:294 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমি শুনতে চাই তাকে,

মস্তিষ্ক মিল পায় যাকে।

আমাদের মস্তিস্ক বিভিন্ন ঘটনার মিল খুঁজতে পারদর্শী। যে কোনো ধরণের বক্তব্য বা কথা আমরা নিজেদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে যাই। নিজেদের অহংবোধ আর মস্তিস্কের মিল খোঁজার প্রবণতা মিলে আমরা যে কোনো গল্পে নিজেদের খুঁজে পাই, তবে শুধু মিল গুলো! অমিলগুলো যেন নিজে থেকে নিভে যায়।

জ্যোতিষ, রাশিফল,বাবাজী, মাতাজী, সাধুবাবা কথায় বা অতীত বা ভবিষ্যৎবানীতে আমরা এভাবে মিলটাই খুঁজে নিই। কিন্তু একবার ভাবুন অন্য যারা একই রাশিফল পড়ছে তারাও আপনার মতই মিল খুঁজে পাচ্ছে- যদিও তাদের জীবন আপনার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।

এ’যেন কিছুটা এমন -

ধরুন, আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা একটি মেয়ে/ছেলে স্ট্যাটাস দিয়েছে, “আমি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা একটি ছেলেকে/মেয়েকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছি না।কি ভাবে বলি বলুন তো?”

আপনি এই স্টাটাস দেখে তৎক্ষণাৎ ভাবতে পারেন, স্ট্যাটাসটি হয়তো আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে।


মজার বিষয় হলো, ঠিক একইভাবে আরো কয়েকজন ফেসবুক ফ্রেন্ড একই কথা ভাববেন যে, মেয়েটি/ছেলেটি হয়তো তাদের উদ্দেশ্যেই কথাটি বলেছেন।  এটাই বার্নাম ইফেক্ট। এই ধরনের বাক্যগুলোতে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয় না। একটা কথা বলা হয়, যা সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে কিন্তু সবাই মনে করে কথাটি কেবল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।


"বার্নাম এফেক্ট" হলো মস্তিষ্কের এমন এক অনুভূতি যখন কোনও সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে নিজের মতামত শুনে বা কোনও রাশিফল পড়ে, আপনি মনে করেন: “এটি অবশ্যই আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ আমার জীবনের কথা"। "আমিতো এমন"। হাঁ আমার জীবনেই তো এমন ঘটেছে"। "আমার সঙ্গেই তো এমনটা ঘটে"। "হাঁ, আমার জীবনে এগুলো ঘটতে পারে"!


১৯৪৮ সালে মনোবিজ্ঞানী বার্ট্রাম ফোরার একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে একটা পার্সোনালিটি টেস্ট করেছিলেন। তিনি সকল ছাত্রদের পৃথক ভাবে ডেকে একটি পত্রিকায় যেমন রাশিফল দেয় তেমন  লেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাদের সঙ্গে কতটা মেলে তা পয়েন্ট দিয়ে জানাতে। সব মিলে গেলে ১০ পয়েন্ট। শিক্ষক একই কথা লেখা কাগজ প্রত্যেকের হাতে তুলে বলেছিলেন দেখো তোমার কথা লেখা আছে কি না। তবে লেখাটি নির্দিষ্ট করে কারোর জন্য ছিল না। তবুও বেশীরভাগ ছাত্র পয়েন্ট দিয়ে জানিয়েছিল তার কথাই লেখা হয়েছে।


কী লেখা ছিল সেই কাগজে? "তুমি সবাইকে আপন ভাবো, ভালোবাসো, কিন্তু সবাই তোমাকে ভালোবাসে না। তোমার কথার সবাই সমালোচনা করে কিন্তু পরে দেখা যায় তোমার কথাই ঠিক ছিল। তোমার কিছু ব্যক্তিগত দুর্বলতা থাকলেও তুমি সেগুলো কাটিয়ে ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে।কারণ তোমার মধ্যে যা প্রতিভা লুকানো আছে তা অনেকের নেই।তোমার শৃঙ্খলাবোধ, দায়বদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস তোমার সম্পদ। সেগুলোই অন্যদের ঈর্ষার কারণ। তবে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে বা সঠিক কাজটি করেছো কিনা তা নিয়ে মাঝে মাঝে তোমার সন্দেহ হয়।তুমি কিছু বৈচিত্র্য, বিশালতা, আর নিজস্বতা পছন্দ করো।কিন্তু তা পাওনা বলে মাঝে মাঝে অস্থির লাগে। তুমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করো; আবার উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া সবকিছু বিশ্বাস করো না। তুমি জেনে গেছো যে অন্য লোকের সাথে খুব খোলামেলা হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই কখনও কখনও তুমি অন্তর্মুখী, সতর্ক আর মিতভাষী।তাই বলে উচিত কথা বলতে তুমি পিছপা হয় না। তবে তোমার কিছু আকাঙ্ক্ষা অবাস্তব।সেটা তুমিও জানো। তবু তুমি স্বপ্ন দেখো। যাইহোক তোমার মধ্যে যা পজিটিভিটি আছে তা দ্বারা অনেক কষ্টের মধ্যেও তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে"।


আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, শিক্ষক মহাশয় অত্যন্ত চতুরতার সাথে এই লেখা লিখেছেন, যাতে বেশিরভাগ ছাত্রের মনের সাথে তা মিলে যায়। প্রত্যেকে যাতে প্রত্যেকের নিজের মতো বিবরণ খুঁজে পেতে পারে। 

এবার আসুন। জ্যোতিষীরা যেভাবে আপনার ভাগ্য বলে দেয়, আমিও সেভাবে আপনার অব্যর্থ ভাগ্যগনণা করে দিই। দেখুন তো এর মধ্যে কয়টি আপনার সঙ্গে মিলে যায়! 


১। আপনার যা Quality সেই পরিমাণ সাফল্য আপনি পান নি।

২। আপনি সবার জন্য করবেন, কিন্তু নাম পাবেন না।

৩। আপনি মুখ ফুটে নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না।

৪। আপনার নিকটজনই কিন্তু আপনার সবথেকে বড় শত্রু।

৫। আপনার প্রতি শণি বিরূপ। বৃহস্পতি ও সদয় নয়। এদের সন্তুষ্ট করতে হবে। নইলে বিপদ। 

৬। বছরের প্রথম দিকে অর্থভাব খুব শুভ হলেও, বছরের মাঝখানে আর্থিক দিকে একটু সমস্যা দেখা দেবে। তবে সেটা সামলে ওঠার ক্ষমতা আপনার আছে।অর্থের ব্যাপারে সতর্ক থাকলে সঞ্চয় ভাল হবে। অর্থ ভাগ্য খুব ভাল হবে এই বছর।

৭। বায়ুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে ও সংসারের সকলের ভালো করতে গিয়ে টেনশন বাড়বে। হার্ট দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা। 

৮। সন্তানরা একটু অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে।

৯। বিভিন্ন ছোটখাটো কারণে আপনার  স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ চলবে। 

১০। অনেক দিনের পুরনো কোনও সম্পর্কে কোনও প্রকার চিড় ধরতে পারে। 

১১। নিজের প্রচেষ্টায়  কিছু আয় বাড়তে পারে।তার জন্য আপনার কলিগদের ঈর্শাভাজন হবেন।

১২। বছরের শেষে ভ্রমণের যোগ আছে।

১৩। প্রেমের বিষয়ে কোনও গোলমাল সামনে এলে, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

১৪।  সম্পত্তির জন্য ভাই ভাই বিবাদ হতে পারে। তার জন্য মানসিক চাপ বাড়তে পারে।

১৫। সামনে আপনাকে অনেকে ভালোবাসলেও প্রকৃত ভালোবাসা আপনি পাবেন না।

১৬। আপনি ভালো মানুষ। সবাইকে খুব সহজে  আপনি বিশ্বাস করেন। সেই সুযোগে তারা আপনাকে ঠকায়।সবাই তো আর আপনার মতো সরল মানুষ না।

১৭। আপনি সবসময় ঠিক কথাই বলেন। প্রথমে সেই কথার গুরুত্ব কেউ দেয় না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আপনার কথাই সত্যি হয়।

১৮। আপনি অপরের বিপদে সবসময় এগিয়ে আসেন। কিন্তু নিজের কোনো বিপদে কাউকে তেমন পাশে পান না।

১৯। সামনে একটা ফাঁড়া আসছে। সাবধানে থাকবেন। ভগবানকে ডাকবেন। বিপদে তিনি আপনাকে রক্ষা করবেন। 

২০। আগামী দু মাস আপনার জন্য অশুভ। 


এই সাধারণ কথাগুলো অনেকের সঙ্গে মিলে যাবে।আর আগেই বলেছি আপনার মস্তিষ্ক তো মিলটাই খুঁজে নেবে।যেটা মিলবে না সেটার কথা ভুলেও ভাববে না! বার্নাম এফেক্ট বা ফোরার এফেক্ট!

জ্যোতিষীরা আপনাকে দেখে এই কথাগুলো তাদের মতো করে আপনাকে বলে।তারা পেশেন্ট/ক্লায়েন্ট ঘেঁটে-ঘেঁটে প্রচুর অভিজ্ঞ। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের হিসেব নিকেষ যেমন ঠিকুজি, কুষ্টি, হস্তরেখা বিচার, কপাল বিচার, বাস্তুশাস্ত্র এইসব ভড়ং বা নাটক করে আপনার বিশ্বাস অর্জন করে। এরপর তারা আপনার মন বুঝে এমন সব কথা বলে যে আপনি সহজেই বিশ্বাস করে নেন যে এগুলো আপনার ভাগ্যে আছে। এই বিশ্বাসের সুযোগ তারা কেন হাতছাড়া করবে! তারা ধান্দাবাজ, চিটিংবাজ  বৈ তো কিছু নয়!!

আধুনিক যুগের পথিকৃৎ: কোপার্নিকাস -
পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:486 | likes:45 | share: 0 | comments:0

সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেলের কথা এলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে নিকোলাস কোপার্নিকাসের নাম । কিন্তু কোপার্নিকাসের অনেক আগেই গ্রিক দার্শনিক সামোসের অ্যারিস্টার্কাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ।খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৭০ সালের দিকে তিনি প্রথমবার সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন।তার মতে পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে।কিন্তু সেই সময় গ্রিসে অ্যারিস্টটল ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এক দার্শনিক।তিনি এই তত্ত্ব নাকচ করেন বলে শোনা যায় । গ্রিসে তার তত্ত্বটি নাকি তেমন কারো সমর্থন পায়নি।এরপর প্রায় অনেক বছর সেই তত্ত্ব কেউ গ্রহণ করেন নি।

এদিকে আবার কোপার্নিকাসের প্রায় এক হাজার বছর আগে ভারতীয় দার্শনিক আর্যভট্ট সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন।তার মডেল অনুযায়ী, পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণনরত এবং গ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুর্ণনকাল ছিল সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে।

এদিকে মধ্যযুগে টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা লিখেছিলেন আরবের বিজ্ঞানী আল হাজেন (আল হাইসাম)।প্রায় ১০০০ সালের দিকে আবু রায়হান বিরুনি (আল বিরুনি) সৌরকেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বেশ জোড়ালো ভাবেই প্রচার করেছিলেন।তার প্রস্তাবনায় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনরত ছিল।সে সময় অন্যদের চরম বিরোধিতায় তিনি হঠাৎ করেই স্থির পৃথিবীর তত্ত্বে ফিরে আসেন।১৩০০ সালের দিকে নাজিদ আল দিন আল খাজইনি আল কাতিবিও সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন।তবে তিনিও শিগগিরিই তার মত পরিবর্তন করেন।

তবে এ বিষয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস ।১৫৪৩ সালে তিনি On the Revolutions of the Celestial Spheres নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।প্রমাণ আছে যে কোপার্নিকাস আরবের বিজ্ঞানী আল কাতিবির কাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।কারণ আল কাতিবির অনেক রেখাচিত্রের সাথে কোপার্নিকাসের রেখাচিত্রের মিল পাওয়া গেছে।এমনকি এসব রেখাচিত্র একই বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন কোপার্নিকাস।তবে অনেকেই মনে করে কোপার্নিকাস আল কাতিবির চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন ।তিনি সুস্পষ্টভাবে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছিলেন।তার যুক্তি ছিল, টলেমির ভূকেন্দ্রিক ব্যবস্থার চেয়ে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ আর যুক্তির সাথে একদম একদম খাপ খায়।আবার এর পাশাপাশি তিনি দার্শনিকগত কিছু ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন।এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল,পৃথিবী বা মানবজাতিই যে সবকিছুর কেন্দ্রে নয়, এ অভিনব ভাবনার প্রকাশ।অবশ্য এই অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করার জন্য তাকে ভুগতে হয়েছিল।খ্রিষ্টীয় গির্জা এই ধারণাকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত হিসেবে দেখেছিল।সে কারণে এ ধারণাকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল তারা।কারণ তাদের দৃষ্টিতে সৌরকেন্দ্রিক ধারণা ছিল বিপথগামিতার নামান্তর।

কোপার্নিকাসের এই বইটি ১৫৪৩ সালে যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।শোনা যায় যখন এই বইটি ছাপা অবস্থায় তার কাছে এসে পৌছালো তখন তিনি শুধুমাত্র বইটি দুইহাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরেই তার মৃত্যু হয়।

কোপার্নিকাস এই বইয়ের মাধ্যমে যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করলেন তার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন, আইনস্টাইন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

কোপার্নিকাস যে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, তিনি ইউরোপের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের মূলে তীব্র আঘাত হেনেছিলেন।তাই বিংশ শতাব্দীতে আইনস্টাইন বলেছিলেন, "বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসই হচ্ছেন আধুনিক যুগের পথিকৃৎ"

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929